ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া এবং ইসলামিক বিধান

ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া

গোসল হল আরবি শব্দ। অর্থ হচ্ছে সমস্ত শরীর ধোয়া। শরিয়তের পরিভাষায়, পবিত্রতা ও আল্লাহর নৈকট্য পাওয়ার উদ্দেশ্যে পবিত্র পানি দিয়ে সমস্ত শরীর ধোয়াকে গোসল বলা হয়। আল্লাহ নির্দেশ দেন, আর তোমরা যদি  অপবিত্র হও, তবে সারা দেহ পবিত্র করে নাও। (সুরা মায়েদা, আয়াত: ৬)

 মাসিক বন্ধ হওয়ার পর নারীদের পবিত্র হওয়ার জন্য গোসল করা ফরজ। সন্তান প্রসবের পর নারীদের গোসল করা ফরজ। মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া ফরজ। পবিত্রতা অর্জনের উদ্দেশ্যে গোসলের ক্ষেত্রে ফরজ গোসলের নিয়ম মানতে হয়। তা না হলে উত্তম রুপে পবিত্রতা হওয়া যায় না।

আজকের আর্টিকেলে ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া, গোসলের পানি কেমন হতে হবে, কোন পানি দিয়ে গোসল না জায়েজ, গোসল কখন মুস্তাহাব সকল বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।


আরও পড়ুনঃ সেহরি, ইফতার, তারাবি এবং রোজার বাংলা নিয়ত


ফরজ গোসলের পানি যেমন হবে

ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া
  • বৃষ্টির পানি
  • কূয়ার পানি
  • ঝর্ণা, সাগর বা নদীর পানি
  • বরফ গলা পানি
  • বড় পুকুর বা টেঙ্কের পানি

ফরজ গোসল যেই পানি দিয়ে করা নাজায়েজ

  • অপরিচ্ছন্ন বা অপবিত্র পানি।
  • ফল বা গাছ হতে নিসৃতঃ পানি।
  • পানির মধ্যে কোন কিছু মিশানোর ফলে পানির বর্ণ, গন্ধ, স্বাদ এবং গাড়ত্ব পরিবর্তিত হয়েছে।
  • পানির পরিমাণ অল্প যাতে অপবিত্র জিনিস মিশে গেছে যেমনঃ মূত্র, রক্ত, মল, মদ ইত্যাদি।
  • অযু, গোসলের পানি (পূর্বে যে পানি দ্বারা গোসল, অযু করা হয়েছে)।
  • অপবিত্র তথা হারাম প্রাণী, যেমনঃ শূকর, কুকুর, আন্যান্য হিংস্র প্রাণীর পানকৃত আবশিষ্ট পানি।

ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া – গোসলের ফরজ

গোসলের ফরজ তিনটি।

  • কুলি করা। (বুখারি, ইবনে মাজাহ) 
  • নাকে পানি দেওয়া। (বুখারি, ইবনে মাজাহ) 
  • সারা শরীর পানি দিয়ে এমনভাবে ধোয়া, যাতে দেহের চুল পরিমাণ জায়গাও শুকনো না থাকে। (আবু দাউদ)

ফরজ গোসলের দোয়া

আরবিঃ  أنا أستحم للتخلص من الجنابة.

উচ্চারণঃ নাওয়াইতুল গুছলা লিরাফইল জানাবাতি। 

অর্থঃ আমি অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার জন্য গোসল করছি।

ফরজ গোসলের নিয়ম

  • গোসলের দোয়া পড়া।
  • গোসলের নিয়ত করে বিসমিল্লাহ বলে দুই হাত কব্জি পর্যন্ত ভালো করে ধৌত করা।
  • এরপর শরীরের কোন জায়গায় অপবিত্র বস্তু থাকলে পানি দিয়ে উত্তম রুপে পরিষ্কার করা।
  • অজু করা। গড়গড়ার সহিত কুলি করা, রোজাদার হলে গড়গড়া করা যাবে না। তিনবার কুলি করা সুন্নত
  • তিনবার নাকে পানি দিয়ে নাক পরিষ্কার করা যাতে নাকের নরম জায়গা র্পযন্ত পানি পৌঁছে।
  • অজুর করার পর মাথায় এমনভাবে পানি ঢালা যেন চুলের গোড়া পর্যন্ত পানি সঠিকভাবে পৌঁছে যায়।
  • ডান কাঁধে পরে বাম কাঁধে পানি ঢেলে সমস্ত শরীর উত্তম রূপে ধৌত করা, যেন শরীরের কোন অংশ শুকনো না থাকা।
  • সর্বশেষে পা ভালেভাবে ধৌত করা।
  • অতঃপর সারা শরীর কোন পরিষ্কার কাপড়, গামছা দিয়ে মুছে শুকনো উত্তম কাপড় পরিধান করা।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর ফরজ গোসলের নিয়ম

এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, হযরত মায়মুনা (রা.) বলেন, আমি আল্লাহর হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জন্য গোসলের পানি রাখলাম। তা দিয়ে তিনি জানাবাতের (অপবিত্রতা থেকে পবিত্র হওয়ার) গোসল করেন। আল্লাহর নবী (সা.) পাত্র হাতে নিয়ে নিজের ডান হাতের ওপর কাত করে তা দুই থেকে তিনবার ধৌত করেন।

অতঃপর তিনি তাঁর লজ্জাস্থানের ওপর পানি ঢেলে বাম হাত দিয়ে ধৌত করেন। পরে তিনি মাটির ওপর হাত ঘষে (দুর্গন্ধমুক্ত হওয়ার জন্য) তা পানি দিয়ে উত্তমরূপে ধৌত করেন।

অতঃপর তিনি কুলি করেন, নাক পরিষ্কার করেন। অতঃপর মুখমন্ডল ও দুই হাত ধৌত করেন। এরপর তিনি নিজের মাথা ও সর্বাঙ্গে পানি ঢালেন। পরে তিনি সেই স্থান থেকে অল্প দূরে সরে গিয়ে উভয় পা ধৌত করেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ২৪৫)

ফরজ গোসল সম্পর্কে আল কোরআন

অরবিঃ إِنَّ اللّهَ يُحِبُّ التَّوَّابِينَ وَيُحِبُّ الْمُتَطَهِّرِينَ

অর্থঃ নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবাকারী এবং অপবিত্রতা থেকে যারা বেঁচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন। (সূরা বাকারা : ২২২)

আরবিঃ فِیۡهِ رجَالٌ یُّحِبُّوۡنَ اَنۡ یَّتَطَهَّرُوۡا وَ اللّهُ یُحِبُّ الۡمُطَّهِّرِیۡنَ 

অর্থঃ সেথায় এমন লোক আছে, যারা পবিত্রতা অর্জন ভালোবাসে এবং পবিত্রতা অর্জনকারীদের আল্লাহ ভালোবাসেন।’ (আল কোরআন ৯:১০৮)।

ফরজ গোসলের শিষ্টাচার

উঁচু স্থানে বসে গোসল করা, যাতে পানি গড়িয়ে যায় পানির ছিটা যাতে গায়ে না লাগে। পানির অপচয় কোনভাবে করা যাবে না। লোকসমাগম যেখানে হয়, সেই স্থানে গোসল না করা। ডান দিক থেকে গোসল শুরু করা। (রদ্দুল মুহতার ১/৯৪) 

বাহ্যিক অঙ্গের চুল পরিমাণ জায়গা শুকনা থাকলে ফরজ গোসল সঠিক শুদ্ধ হবে না। (শরহে-খতাসারুত তাহাভি ১/৫১০)

নেল পালিশ, রং, সুপার গ্লু ইত্যাদি যা শরীরে পানি পৌঁছার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হয়, তা উঠিয়ে নিচে পানি পৌঁছানো জরুরি, না হলে গোসল শুদ্ধ হবে না। (ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/১৩)

ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া অনুসারে গোসল শুরু করতে হবে।ফরজ গোসলে পুরুষের দাঁড়ি ও মাথার চুল গোড়ায় সম্পূর্ণ ভালোভাবে ভিজতে হবে। নারীদের চুলের গোড়ায় পানি পৌঁছানো। সম্পূর্ণ চুল ধোয়া। ( বাদায়েউস সানায়ে ১/৩৪, রদ্দুল মুহতার ১/১৪২)

নারীদের কান ও নাকফুল নাড়িয়ে ছিদ্রে পানি পৌঁছানো জরুরি। (আল মুহিতুল বুরহানি ১/৮০)

তবে  কানের ভেতর, নাভিতে যাতে পানি পৌঁছায় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।

অনেকের দাঁতে ক্যাপ লাগানো হয়ে থাকে, কুলি করলে নিচে পানি পৌঁছে না। তা খুললেও ক্ষতির আশঙ্কা হয়, তাহলে গোসলের সময় তা খোলা জরুরি নয়। যদি এমন কিছু লাগানো থাকে, যা সহজে খোলা যায়, তাহলে খুলে তার নিচে পানি পৌঁছানো জরুরি। (রদ্দুল মুহতার ১/১৫৪, আহসানুল ফাতাওয়া ২/৩২)।

কখন গোসল করা ফরজ

 যে সব কারণে গোসল করা ফরজ ।

  • স্বামী-স্ত্রী সহবাস করলে কিংবা পুরুষের স্বপ্নদোষ হলে। 
  • নারীদের ঋতুস্রাব অথবা পিরিয়ড হলে।
  • সন্তান প্রসবের পর রক্তপাত বন্ধ হলে।
  • মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেওয়া জীবিতদের জন্য।
  • কোনো অমুসলিম ইসলাম গ্রহণ করলে।

কখন গোসল করা সুন্নত

যে সব কারণে গোসল করা সুন্নত

  • জুমার নামাজের আগে গোসল করা সুন্নত। 
  • ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার নামাজে আদায় করতে যাওয়ার পূর্বে গোসল করা সুন্নত। 
  • ইহরামের জন্য গোসল করা সুন্নত। 
  • হাজীদের আরাফায় অবস্থানের সময় গোসল করা সুন্নত।

কখন গোসর করা মুস্তাহাব

যে সব কারণে গোসল করা মুস্তাহাব

  • পবিত্র থাকা অবস্থায় ইসলাম গ্রহণকারী ব্যক্তির জন্য গোসল করা মুস্তাহাব ।
  • বয়সের মাধ্যমে বালেগ হয়েছে এমন ব্যক্তির জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
  • উম্মাদনা হতে যে সুস্থতা লাভ করেছে, এমন ব্যক্তির জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
  • সিঙ্গা লাগানোর পর গোসল করা মুস্তাহাব।
  • মৃত ব্যক্তিকে গোসল দেয়ার পর গোসল করা মুস্তাহাব।
  • শবে বরাতের রাতে গোসল করা মুস্তাহাব।
  • শবে কদরের রাতে গোসল করা মুস্তাহাব। যদি তা উপলব্ধি করতে পারা যায় ।
  • মদীনা শরীফে প্রবেশের পূর্বে গোসল করা মুস্তাহাব।
  • ইয়াওমুন্নাহার (১০ই জিলহজ্জ) সকালে মুযদালিফায় অবস্থান করতে গেলে জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
  • মক্কা শরীফে প্রবেশের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
  • তাওয়াফে যিয়ারত করার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
  • সূর্য গ্রহণের নামাজের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
  • ইস্তেকার নামাজ আদায় করার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
  • খউফের (ভয়-ভীতি কালীন) নামাজ আদায় করার জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।
  • সফর থেকে বাড়ী পৌঁছে গোসল করা মুস্তাহাব।
  • কঠিন ঝড়-ঝঞ্ঝা বায়ু থেকে মুক্তির নামাযের জন্য গোসল করা মুস্তাহাব।

পরিশেষে

প্রত্যেক মুমিন দের জন্য ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া একই। সুন্নত পালন করে সঠিক নিয়মে ফরজ গোসল করতে হবে।আমাদের সকলকে ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া মাথায় রেখে ভাবে উত্তম রূপে গোসল করতে হবে। 

সঠিক নিয়মে গোসল না করলে পবিত্রতা অর্জন হয় না। তাই উত্তমরূপে গোসল করা,গোসলের পানি পবিত্র কিনা সেদিকে অবশ্যই কেযাল রাখতে হবে। আশা করি সম্পূরর্ণ আর্টিকেলে ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া সম্পর্কিত সকল বিষয় ভালোভোবে বোঝাতে পেরেছি। ধন্যবাদ।

ফরজ গোসলের নিয়ম ও দোয়া সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

১। গোসল ফরজ অবস্থায় দোয়া করা যাবে কি?

উত্তরঃ বিভিন্ন মাজহাবের মত উল্লেখ করতে যেয়ে জগদ্বিখ্যাত গ্রন্থ আলফিকহু আলা মাজাহিবিল আরবাআতে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘হানাফি ফেকাহবিদদের মতে, যার ওপর গোসল ফরজ তার জন্য কোরআন পাঠ করা হারাম।

২। ফরজ গোসল না করে কি কি কাজ করা যায়?

উত্তরঃ কারো ওপর গোসল ফরজ হলে সঠিক পদ্ধতিতে গোসল আদায় না করা পর্যন্ত ওই ব্যক্তি নাপাক থাকে। আর নাপাক অবস্থায় নামাজ পড়লে সওয়াবতো হবেই না বরং কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

৩। জানাবাত শব্দের অর্থ কি?

উত্তরঃ জুনুব (جنب) হল একটি [ইসলামি পরিভাষায় অর্থ যার হল যৌনসঙ্গম বা বীর্যস্খলনের কারণে ধর্মীয়ভাবে অপবিত্র হওয়া।

আরও পড়ুন-

ঋণ মুক্তির দোয়া, আমল ও ঋণ থেকে নাজাতের পথ

ফরজ গোসল না করার শাস্তি, শরীয়তের বিধান ও নিয়ম

Leave a Comment