জ্বর হলে করণীয় কি, যা বর্জনীয় ও ঘরোয়া উপায়

জ্বর হলে করণীয় কি

আবহাওয়া পরিবর্তনের রেশ এখনও প্রবল রয়েছে। সঙ্গে চলছে মৌসুমী সর্দি-কাশির সাথে জ্বরও। আশপাশের অনেকেই হয়ত এই রোগগুলোতে আক্রান্ত হয়েছেন বা হচ্ছেন। যা আপনারও আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলছে প্রতিনিয়ত।

এরমধ্যেই কেউ কেউ আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। যা অন্যান্যদের সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা বাড়াচ্ছে। জ্বর আসলে কোনো গুরুত্বর রোগ নয়। এটা একটা উপস্বর্গ মাত্র, যা ইনফেকশন বা ইনফ্লামেশনের প্রতি শরীরের রোগ প্রতিরোধ প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ।

৯৮.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট মানুষের শরীরের স্বাভাবিক তাপমাত্রা। শরীরের তাপমাত্রা ৯৯ ডিগ্রি বা ৯৯.৯ ডিগ্রি হলে কিন্তু সেটা জ্বর হিসেবে ধরা হয় না। এটার জন্য কোন প্রকারের পরীক্ষা নিরীক্ষা করার কোন প্রয়োজন পড়ে না।

অনেক সময় সব ভাইরাল ফিভার সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যায়। জ্বরের স্থায়ীত্ব সাত দিনের বেশি হলে আমরা সেটিকে টাইফয়েড, টাইফাস বা রিকেটশিয়া হিসেবে ধরা হয়।

রোগের তীব্রতা লাগামহীন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে খুব জরুরী। তবে প্রথম অবস্থায় ঘরোয়া কিছু করণীয়, বর্জণীয় বিষয় মেনে চললে ওষুধ ছাড়াই আরোগ্য লাভ সম্ভব।

আজকের আর্টিকেলে জ্বর হলে করণীয় কি, যা বর্জনীয়, জ্বর কমানোর ঘরোয়া উপায় ইত্যাদি সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।


আরও পড়ুনঃ টাইফয়েড জ্বরের এন্টিবায়োটিক, সতর্কতা ও চিকিৎসা


জ্বর হলে করণীয়

জ্বর হলে করণীয় কি

জ্বর হলে করণীয় কি বলতে সহজ কিছু মাধ্যম পালন করে ঔষধ ছাড়াই জ্বর কমানো যেতে পারে।

প্রচুর তরল পান

মৌসুমি রোগ নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে, আপনি প্রথম উপদেশ পাবেন প্রচুর পানি সাথে অন্যান্য তরল পান করার। কারণ হল জ্বরের কারণে তাপমাত্রা বাড়লে শরীর দ্রুত পানিশূন্যতার দিকে এগোতে থাকে। তাই পর্যাপ্ত পানি পান করা শরীরের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

কুসুম গরম পানি, ফলের শরবত, ডাবের পানি, চা- যে কোনো তরল খাবার গ্রহণে বাধা নেই। সর্দি-জ্বর থাকলে প্রতিদিনের লক্ষ্য হবে আট থেকে ১২ গ্লাস পানি পান করতে হবে। আর বেশি তরল পান করলে শরীর থেকে জীবাণু ,অন্যান্য বিষাক্ত উপাদান খুব সহজেই শরীর থেকে বের হয়ে যায়।

পর্যাপ্ত বিশ্রাম

অসুস্থ অবস্থায় যত বেশি সক্রিয় থাকবেন ততই আপনার শরীরের তাপমাত্রা বাড়তে থাকবে। তাই যথা সম্ভব বিশ্রামে থাকলে তাপমাত্রা কমবে, যা রোগমুক্তি করতে দ্রুত সাহায্য করবে। 

মৌসুমি সর্দি কাশি, জ্বর সারাতে সাধারণত ওষুধ প্রয়োজন হয় না। কিন্তু জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হলে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী ঔষধ খাওানো নিরাপদ। 

জ্বরের সঙ্গে শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, ঘাড় শক্ত হয়ে থাকা, বমি ইত্যাদি লক্ষণ থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অতি জরুরী।

নিয়মিত গোসল

কপাল, ঘাড়ের পেছনে জলপট্টি দেওয়া জ্বর কম করতে খুবই কার্যকারী। সম্পূর্ণ শরীর গোসলের পরিবর্তে কুসুম গরম পানিতে ভেজানো কাপড় দিয়ে কিছুক্ষণ পর পর মুছে দিলে দ্রুত জ্বর কমাতে সাহায্য করে থাকে। 

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া শরীরে জ্বর নিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা মোটেও উচিত নয়। না হলে শরীরে কাঁপুনি দেখা দিবে, যার ফলে জ্বরের মাত্রা আরও বেড়ে যেতে পারে।

যে সব বর্জনীয়

আমাদের জ্বর হলে করণীয় কি জানার চেয়ে, জ্বর হলে যেসব বর্জন করতে সেটা জানাটা জরুরী। কিছু জিনিস রয়েছে যেগুলো বর্জন করা আব্যশক।

শরীরে ‘অ্যালকোহল’ মালিশ

জ্বর কমানো প্রাচীন এক পদ্ধতি রয়েছে। যে পদ্ধতি অবলম্বন করা মোটেই নিরাপদ নয়। এই পদ্ধতি জ্বর সারাতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অকার্যকর হয়েছে। বরং তার ফলে ‘অ্যালকোহল’জনীত বিষক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।

বরফ গোসল

বরফ শীতল পানি বা বরফ ভাসা পানিতে গোসল করার জন্য হয়ত শরীরের তাপমাত্রা কমবে, কিন্তু তার ফলে শরীরে প্রচণ্ড কাঁপুনি শুরু হবে। ফলে জ্বর আরও বাড়তে থাকবে।

স্বাভাবিক তাপামাত্রার পানিতে যেখানে গোসল করা নিষেধ, সেখানে বরফ শীতল পানিতে গোসলের কথা অবান্তর।

দ্বিগুন ওষুধ সেবন

দ্রুত জ্বর থেকে মুক্তি পেতে চিকিৎসকের নির্দেশনা দেওয়া ব্যাতিত ওষুধ দ্বিগুন পরিমাণে সেবন বা একই সঙ্গে দুই ধরনের ওষুধ সেবনের ফলে হিতে বিপরিত হবে। তা পরে জ্বরের থেকেও বিপদজনক হতে পারে। 

বেশি ওষুধ খেলেই যে শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত কমে যাবে তা কিন্তু মোটেও না। তবে এমনট করলে শরীরের বিভিন্ন অভ্যন্তরীন অঙ্গের ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বিশেষত বৃক্কের।

অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণে সাবধানতা

জ্বর বেড়ে গেলে অনেকেই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে চায়। অ্যান্টিবায়োটিক জ্বর কমাতে সাহায্য করে না, শরীরে প্রবেশ করা জীবাণুকে মেরে ফেলে যা শরীরকে দুর্বল করে দেয়। অকারণে অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের ফলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স হতে পারে।

ভবিষ্যতে ওই অ্যান্টিবায়েটিক আর কাজ করতে পারে আবার নাও পারে। এই জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্লাড কালচার, ইউরিন কালচার এ সকল টেস্ট করিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করাই উত্তম।

শিশুদের ক্ষেত্রে যখন চিকিৎসক জরুরি

শিশুদের জ্বর হলে করণীয় কি এটা জানাও আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

  • ৩ মাস বয়সী শিশুর জ্বর হলে, যদি শরীরের তাপামাত্রা ১০০.৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট হয় অতি দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া জরুরী।
  • শিশুর বয়স ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে হলে জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট পার করলে, শিশু ঘুমকাতুরে বা অধিক কান্নাকাটি করলে দ্রুত চিকিৎসকের সরনাপন্ন হতে হবে।
  • ছয় থেকে ২৪ মাস বয়সি শিশুর ক্ষেত্রে জ্বর ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে, যদি তা একদিনের বেশি স্থায়ী হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরী। জ্বরের সঙ্গে ডায়রিয়া, বমি, সাথে ত্বকের ‘র‌্যাশ’ দেখা দিলে অবশ্যই চিকিৎসকের সরনাপন্ন হওয়া আব্যশক।

খাবারে অরুচি দূরীকরণ

জ্বর হলে করণীয় কি হিসেবে আরও একটি করণীয় খাবারে অরুচি দূরীকরণ। জ্বর হলে বমিভাব থাকে, যার জন্য খাবারে অরুচি আসতে পারে। বমিভাব কমাতে ডমপেরিডন বা অমিডন জাতীয় ওষুধ সেবন করা ভালো। 

এ ছাড়া রোগীর পছন্দের খাবারগুলো খাদ্য তালিকায় যুক্ত করা যেতে পারে। জ্বরের সময় রোগীকে সুস্থ হতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সম্পন্ন খাবারের জোগান দিতে হবে। এর জন্য রোগীকে সুষম খাবার গ্রহণ করতে হবে।

যাতে প্রয়োজনীয় ভিটামিন, মিনারেলস, কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন সব কিছুর জোগান মিলবে,যা অল্প দিনের মধ্যেই রোগীকে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে।

ঘরোয়া উপায়ে জ্বর কমানো

জ্বর হলে করণীয় কি জানার সাথে সাথে জ্বর কমানোর ঘরোয়া উপায়গুলো সকলের জানতে হবে।

তুলসি পাতার ব্যবহার

৮-১০টি তুলসি পাতা নিয়ে পাতাগুলো পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে। একটি পাত্রে পানি গরম করতে হবে। এর মধ্যে তুলসি পাতা দিতে হবে। ভালোভাবে ফুটিয়ে নিতে হবে। এই পানি প্রতিদিন সকালে এককাপ করে খেতে হবে। 

তুলসি পাতায় থাকা অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিবায়োটিক উপাদান জ্বর, সর্দি, গলা ব্যথা, ব্রংকাইটিস, ম্যালেরিয়ার মতো অনেক রোগ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করবে। 

তুলসি পাতা শরীরের তাপমাত্রা কমাতে যথেষ্ট সাহায্য করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে।

জ্বর কমাতে মধু

এক চা চামচ মধু, অর্ধেকটা লেবুর রস, এককাপ গরম পানি নিতে হবে। সবগুলো একসঙ্গে ভালো ভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। এই মিশ্রণ দিনে দুইবার খেতে হবে। মধুতে আছে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল উপাদান, যা শরীরের ব্যাকটেরিয়াকে ধ্বংস করতে সাহায্য করে। 

এর ফলে ভাইরাসজনিত জ্বর খুব সহজেই কমানো যাবে। ভাইরাস জনিত রোগের ক্ষেত্রে লেবুর রস ও মধু খুবই গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। যা শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা দ্রুত কমাতে সাহায্য করে।

আদা দিয়ে সমাধান

আধা চা চামচ আদা বাটা সাথে এক চা চামচ মধু নিতে হবে। এককাপ গরম পানিতে আদা বাটা দিয়ে ভালোভাবে ফুটিয়ে নিতে হবে। তারপর তার মধ্যে মধু মেশাতে হবে। 

এই মিশ্রণ দিনে ৩ – ৪ খেতে হবে। তা ছাড়া এক চা চামচ লেবুর রস, আধা চা চামচ আদার রস, এক চা চামচ মধু মিশিয়ে মিশ্রণ তৈরি করতে হবে। প্রতিদিন ৩ – ৪ খাওয়া যাবে। 

এতে জ্বর কমতে থাকবে। কারণ আদা হলো প্রাকৃতিক অ্যান্টি ভাইরাস। এটি শরীরের তাপমাত্রা দ্রুত হ্রাস করতে সাহায্য করে।

জ্বর কমাতে রসুনের ব্যবহার

এককোয়া রসুন সাথে এককাপ গরম পানি নিন। রসুন কুচি করে নিয়ে গরম পানিতে দশ মিনিট ভিজিয়ে রাখতে হবে। তারপর রসুনের কুচিগুলো ছেঁকে নিয়ে পানিটুকু চায়ের মতো খেয়ে নিতে হবে। এভাবে প্রতিদিন দুইবার খেতে হবে। 

তারপর রসুন ছেঁকে নিয়ে সঙ্গে অলিভ অয়েল মিশিয়ে মিশ্রণটি পায়ের তালুতে ভালো ভাবে লাগিয়ে নিতে হবে। 

এরপর পাতলা কাপড়ে পা পেঁচিয়ে সারারাত রেখে দিতে হবে। সকালে উঠে দেখবেন জ্বর একেবারে কমে গেছে। তবে গর্ভবতী নারী বা শিশুদের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি প্রয়োগ করা যাবে না।

পরিশেষে

জ্বর হলে করণীয় কি? জ্বর হলে বিভ্রান্ত হওয়ার কিছু নেই। সাধারণত ভাইরাসের সংক্রমণ, ঋতু পরিবর্তনের ফলে জ্বর হতে পারে। কিছু জ্বর মশা বাহিত, পানিবাহিত ইত্যাদি কারণে হতে পারে।

সাধারণ জ্বর হলে আমরা ঔষধ খাওয়ার জন্য অস্থির না হয়ে, চেষ্টা করবো ঘরোয়া পদ্ধতিতে জ্বর কমনোর। যদি জ্বর না কমে সেক্ষেত্রে চিকিৎসকের সরনাপন্ন হবো।

এ্যান্টিবায়োটিক সর্বোচ্চ প্রয়োজন না হওয়া অব্দি না গ্রহণ করার চেষ্টা করবো। আশা করি আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে জ্বর হলে করণীয় কি সম্পর্কিত বিষয় বিস্তারিত বোঝাতে পেরেছি। ধন্যবাদ।

জ্বর হলে করণীয় কি সম্পর্কিত প্রশ্ন উত্তর / FAQ

১। জ্বর ১০০ হলে করণীয় কি?

উত্তরঃ জ্বর হলে করণীয় কি। শরীরে ১০০-১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রা হলে ট্যাবলেট হিসেবে ভরাপেটে প্যারাসিটামল খেতে হবে। ১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে সাপোজিটরি দিতে হবে। জ্বরের তিন দিন পর্যন্ত অস্বাভাবিক কোনো লক্ষণ না থাকলে রোগী শুধুই প্যারাসিটামল গ্রহণ করবে। জ্বর বেড়ে গেলে অনেকের মাঝে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়।

২। জ্বর হলে প্রাথমিক চিকিৎসা কি?

উত্তরঃ মাথায় পানি ঢালা যেতে পারে এবং কপালে পানিপট্টি দেওয়া যেতে পারে। কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করানো যেতে পারে। প্রচুর তরল খাদ্য ও পানীয় খেতে দিতে হবে। জ্বর ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের বেশি হলে প্যারাসিটামল মাত্রানুযায়ী খাওয়াতে হবে।

৩। বাচ্চার জ্বর না কমলে কি করব?

উত্তরঃ “সত্যিই, আপনার সন্তান কেমন দেখায় বা কাজ করে বা জ্বর কতক্ষণ থাকে তার চেয়ে সংখ্যাটি কম গুরুত্বপূর্ণ,” ব্লামবার্গ বলেছেন। “জ্বর সাধারণত সংক্রমণের স্বাভাবিক গতিপথ অনুসরণ করে যা সাধারণত এক থেকে চার দিন হয়। এর পরে, আপনার শিশুরোগ বিশেষজ্ঞকে কল করার সময় এসেছে।

আরও পড়ুন –

ঠান্ডা কাশির ঔষধের নাম, কার্যকারিতা ও চিকিৎসা

ঘুমের ঔষধের নাম কি, কাজ ও ওষুধ খাওয়ার নিয়ম

Leave a Comment