হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয়
হৃৎপিণ্ডের ধমনীতে রক্ত প্রবাহের চাপ অনেক বেশি বেড়ে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। দু’টি মানের মাধ্যমে এই রক্তচাপ পরিমাপ করা হয়। যেটার পরিমাপ বেশি সেটাকে বলা হয় সিস্টোলিক প্রেসার, আর যেটার পরিমাপ কম সেটা ডায়াস্টলিক প্রেসার।
প্রতিটি হৃৎস্পন্দন অর্থাৎ হৃদপিণ্ডের সংকোচন, সম্প্রসারণের সময় সিস্টোলিক চাপ ও ডায়াস্টলিক চাপ সৃষ্টি হয়। একজন সুস্থ মানুষের স্বাভাবিক রক্তচাপ ১২০/৮০ মিলিমিটার হয়ে থাকে।
যদি কারও রক্ত চাপ ১৪০/৯০ মিলিমিটার এর চেয়েও বেশি হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। রক্তচাপ ৯০/৬০ মিলিমিটার এর কাছাকাছি থাকলে সেটি লো ব্লাড প্রেসার।
যদিও বয়স ভেদে রক্তচাপের কিছুটা তারতম্য দেখা দিতে পারে। আজকের আর্টিকেলে হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয়, লক্ষণ, উচ্চ রক্তচাপের কারণ ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিত তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
আরও পড়ুনঃ বড়দের কাশির সিরাপ, কার্যকারিতা ও সেবনবিধি
উচ্চ রক্তচাপ হলে কী করবেন

হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয় জীবনযাপনে পরিবর্তন আর নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেলে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এজন্য কিছু বিষয়ের প্রতি আমাদের মনোযোগী হতে হবে।
- খাবারে লবণের পরিমাণ কম করে দিতে হবে। লবণে সোডিয়ামের উপস্থিতির রয়েছে, যার কারণে রক্তের জলীয় অংশ বেড়ে যায়। ফলে রক্তের আয়তন ও চাপ দুটোই বাড়ে।
- ধূমপান ও মদ্যপান বর্জন করা। ধূমপান শরীরে নানা ধরণের বিষাক্ত পদার্থের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যার ফলে ধমনী ও শিরার নানারকম রোগ-সহ হৃদরোগ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শরীরের ওজন অতিরিক্ত বেড়ে গেলে হৃদযন্ত্রের কার্যকলাপ বেড়ে যায়।যার ফলে অতিরিক্ত ওজনের মানুষের মধ্যে সাধারণত উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বেশি পরিমাণে দেখা যায়।
- নিয়মিত ব্যায়াম বা কায়িক পরিশ্রম করতে হবে। নিয়মিত ব্যায়াম ও শারীরিক পরিশ্রম করলে হৃৎপিণ্ড সবল থাকে এবং ওজন হ্রাস করতে সহায়তা করে থাকে। যার ফলে রক্তচাপও নিয়ন্ত্রণে থাকে।
- মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা কম করতে হবে। রাগ, উত্তেজনা, ভীতি অথবা মানসিক চাপের কারণেও রক্তচাপ সাময়িকভাবে বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘসময় ধরে মানসিক চাপ থাকলে দীর্ঘমেয়াদে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা সৃষ্টি হয়ে থাকে।
- খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করতে হবে। মাংস, মাখন বা তেলে ভাজা খাবার, অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাবার খেলে ওজন বৃদ্ধি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া অতিরিক্ত কোলেস্টোরেল যুক্ত খাবার খাওয়ার ফলেও রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ, রক্তে অতিরিক্ত কোলেস্টোরেল রক্তনালীর দেয়াল মোটা ও শক্ত করে ফেলে। এর ফলেও উচ্চ রক্তচাপ অধিক পরিমাণে দেখা দেয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ
হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয় অবলম্বন করার পূর্বে জানতে হবে উচ্চ রক্তচাপের কারণ সম্পর্কে।
- বয়স যদি ৪০ বছর থেকে বেশি হয় তবে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়তে থাকে।
- অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা।
- পরিবারে কারও উচ্চ রক্তচাপ থাকলে।
- নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম না করলে।
- প্রতিনিয়ত ৬ গ্রাম বা এক চা চামচের বেশি লবণ খেলে।
- ধূমপান, মদ্যপান, অতিরিক্ত ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য বা পানীয় খেলে।
- দীর্ঘদিন ধরে ঘুমের সমস্যা হলে।
- শারীরিক ও মানসিক চাপ থাকলে।
উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ
হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয় জানার পূর্বে উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ সম্পর্কে জানতে হবে। একেবারে সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষণ সেভাবে প্রকাশ পায় না। সাধারণ কিছু লক্ষণের রয়েছে-
- প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হতে থাকে, মাথা গরম হয়ে যায় এবং মাথা ঘোরাতে থাকে।
- ঘাড়ে ব্যথা অনুভব হয়।
- বমি বমি ভাব বা বমি হতে থাকে।
- অল্পতেই রেগে যাওয়া বা অস্থিরতায় শরীর কাঁপতে থাকে।
- রাতে ভালো ঘুম হয় না।
- কানের মাঝে শব্দ হতে থাকে।
- অনেক সময় অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।
এসব লক্ষণ দেখা দিলে হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয় অবলম্বন করার সাথে, নিয়মিত প্রেসার পরিমাপ করতে হবে। চিকিৎসকরা নিয়মিত প্রেসার কমানোর ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ হলে কী সমস্যা তৈরি হয়
হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয় অবলম্বন করার পাশাপাশি উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অঙ্গে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
উচ্চ রক্তচাপ থেকে হৃদযন্ত্রের পেশিগুলো দুর্বল হয়ে যেতে থাকে। এর ফলে দুর্বল হৃদযন্ত্র রক্ত পাম্প করতে না পেরে ব্যক্তির হৃতপিণ্ড কাজ বন্ধ করার ফলে, হার্ট ফেল করার সম্ভাবনা বেশি। এমন সময় রক্তনালীর দেয়াল সংকুচিত হয়ে হার্ট অ্যাটাকের মারাত্মক সম্ভাবনাও রয়েছে।
উচ্চ রক্তচাপের ফলে কিডনি নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, মস্তিষ্কে স্ট্রোক, রক্তক্ষরণও গুরুত্বর হতে পারে। এ ক্ষেত্রে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি হয়ে থাকে। বিশেষ কারণে উচ্চ রক্তচাপের ফলে রেটিনায় রক্তক্ষরণ হয়ে একজন মানুষ অন্ধত্বও হয়ে থাকেন।
একটি ভয়ের বিষয় হল, উচ্চ রক্তচাপের কোনো প্রাথমিক লক্ষণ না থাকায় এই সমস্যায় প্রায় শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। রোগী কখনো বুঝতে পারে না যে প্রতিনিয়ত তিনি শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
যারা দীর্ঘ সময় ধরে রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছেন, তাদেরকে অব্যশই প্রতি সপ্তাহে একবার রক্তচাপ পরিমাপ করে দেখতে হবে। তবে একবার রক্তচাপ বেশি হলেই যে উচ্চ রক্তচাপ আছে, সেটা ধারণা করা যাবে না। কারও তিন মাস উচ্চ রক্তচাপ দেখা গেলে, তাহলে বলা যাবে তার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা আছে কিনা।
ঔষধ ছাড়াই উচ্চ রক্তচাপ কমানোর উপায়
ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন
অতিরিক্ত ওজন কম করতে হবে। কোমর বা পেটের বাড়তি চর্বি কমানোর মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষদের জন্য কোমরের মাপ যদি ৪০ ইঞ্চির বেশি হয় থাকে, মহিলাদের ক্ষেত্রে যদি কোমরের মাপ ৩৫ ইঞ্চির বেশি হয়। তাহলে তারা উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকিতে আছে বলে ধারণা করা হয়।
ওয়ার্ক আউট করুন
নিয়মিত ব্যায়াম করলে প্রায় ৫ থেকে ৮ মিলিমিটার উচ্চ রক্তচাপ কমানো সম্ভব। তাই নিয়মিত ব্যায়াম করে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অত্যন্ত কার্যকরী। প্রাথমিক অবস্থায় প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হালকা ব্যায়াম করা প্রয়োজন।
আউটডোর এক্সারসাইজ করতে চাইলে হাঁটাহাঁটি, জগিং, সাইক্লিং, সাঁতার কাটা ইত্যাদি বেশ ভালো অপশন। বাইরে যেতে না পারলে ঘরেই ব্যায়াম করে নিতে হবে। এই লাইট ওয়ার্ক আউট আপনাকে ফিট থাকতে অনেক জরুরী।
ঘুমের ব্যাঘাত যাতে না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখুন
সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণ ঘুম জরুরী। পর্যায়ক্রমে কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রতি রাতে ৬ ঘন্টার কম ঘুমালে উচ্চ রক্তচাপ দেখার সম্ভাবনা বেশি। স্লিপ অ্যাপনিয়া , স্লিপিং ডিজঅর্ডার, ইনসমনিয়া, নিদ্রাহীনতা, দুশ্চিন্তা ইত্যাদির ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম হয় না।
উক্ত সমস্যার কোনোটিতে ভুগে থাকলে তা চিহ্নিত করে দ্রুত দূর করার ব্যবস্থা নিতে হবে। চিকিৎসক যদি ঘুমের জন্য ঔষধ সেবন করতে দেন, তাহলে সেটা নির্দিষ্ট পরিমাণে খেতে হবে।
টেনশন ফ্রি থাকার চেষ্টা করুন
হাই ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণের জন্য সব ধরনের দুশ্চিন্তা দূর করতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী মানসিক চাপের জন্য উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হতে পারে। অতিরিক্ত কাজের প্রেসার, আর্থিক অবস্থার অবনতি, পারিবারিক কলহ বা অসুস্থতা ইত্যাদি উচ্চ রক্তচাপের সৃস্টির কারণ।
শারীরিক, মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে দুশ্চিন্তা, মানসিক চাপের কারণ কী তা দ্রুত খুঁজে বের করে এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।
নিয়মিত রক্তচাপ মনিটর করুন
উচ্চ রক্ত চাপের রোগীর রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করতে হবে। যেকোনো শারীরিক অসুস্থতায় দ্রুত চিকিৎসকের সরনাপন্ন হতে হবে। ভুললে হবে না, মানসিক সুস্থতার জন্য পরিবারের পরিবেশ শান্তিময় হওয়া অত্যন্ত জরুরী।
উচ্চ রক্ত চাপের রোগী ঠিকমতো ঔষধ সেবন করছে কিনা, স্বাস্থ্যকর খাবার পাচ্ছে কিনা, সে বিষয়ে পরিবারের সদস্যদেরও সবসময় খেয়াল রাখতে হবে।
পরিশেষে
উচ্চ রক্তচাপের রোগীর পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে। এমন অবস্থায় নিয়মিত প্রেসার পরিমাপ করতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসকের নির্দেশনা অনুযায়ী উচ্চ রক্তচাপের ঔষধ সেবন করতে হবে।
হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয় অবলম্বনের পাশাপাশি কিছু নিয়ম কানুন মেনে চললে উচ্চ রক্ত চাপ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যদি উচ্চ রক্ত চাপ চিহ্নিত করা যায় ঔষধ সেবনের পাশাপাশি পুষ্টিকর খাবারও খেতে হবে।
আশাকরি আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয় সম্পর্কিত বিস্তারিত বোঝাতে পেরেছি।
হঠাৎ প্রেসার বেড়ে গেলে করণীয় সম্পর্কিত প্রশ্ন-উত্তর / FAQ
১। হাই প্রেসারের ঔষধ বেশি খেলে কি হয়?
উত্তরঃ ওল্মেসিপ ২০ এম জি ট্যাবলেট (Olmecip 20 MG Tablet), একটি এনজিওটেসটিনn2 রিসেপ্টর ব্লকার (এআরবি), ‘কমানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি একা ব্যবহার করা হয় বা অন্যান্য ঔষধের সাথে সমন্বয় ব্যাবহার করা জেতে পারে । এটি রক্তচাপকে শিথিল করতে সাহায্য করে রক্তচাপ কমায়, ফলে রক্ত সহজে চলতে পারে।
২। উচ্চ রক্তচাপ কি বিপরীত?
উত্তরঃ যদিও উচ্চ রক্তচাপের কোনো নিরাময় নেই , রোগীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা গুরুত্বপূর্ণ, যেমন কার্যকর জীবনধারা পরিবর্তন করা এবং তাদের চিকিত্সকদের দ্বারা নির্ধারিত BP-হ্রাসকারী ওষুধ গ্রহণ করা।
৩। পনির কি উচ্চ রক্তচাপের জন্য ক্ষতিকর?
উত্তরঃ আপনার খাদ্যতালিকা থেকে পনির বাদ দিতে হবে না, তবে আপনার যদি উচ্চ কোলেস্টেরল বা রক্তচাপ থাকে তবে অল্প পরিমাণে উচ্চ চর্বিযুক্ত পনির ব্যবহার করুন। পনিরের একটি 30 গ্রাম অংশ আপনার দৈনিক ক্যালোরির সাত শতাংশ প্রদান করে এবং চেডারের একটি অংশে ক্রিস্পের প্যাকেটের চেয়ে বেশি লবণ থাকতে পারে।
আরও পড়ুন-
শিশুর জ্বর ১০২ হলে করণীয় ও প্রাথমিক চিকিৎসা
মাজা ব্যাথার ঔষধের নাম, দাম ও ঔষধের সেবনবিধি