যাকাত দেওয়ার নিয়ম ও হাদিস মোতাবেক পরিমান

যাকাত দেওয়ার নিয়ম 

ইসলাম ধর্মে পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত একটি। প্রতিবছর রমজান মাসে সাধারণ মুসলিম ব্যক্তিরা যাকাত প্রদান করেন।

কিন্তু যাকাত কতোটুকু দিতে হবে এবং যাকাত দেওয়ার নিয়ম কি সেই বিষয়ে অনেকে কিছু আমরা জানি না। প্রতিটা ধনী ব্যক্তির যাকাত দেওয়া ফরজ।

যাকাত দিলে ধনসম্পদ বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যায়। আসুন যাকাত দেওয়ার সঠিক নিয়ম আলোচনা করি।

আরও পড়ুনঃ যাকাত কাদের উপর ফরজ, যাকাতের পরিমান ও নিসাব

যাকাত কি

যাকাত দেওয়ার নিয়ম

অর্থ-সম্পদের অতিরিক্ত অংশ শরীয়াতের নিয়ম মোতাবেক আল্লাহর পথে ব্যয় করা ফরজ করা হয়েছে এবং এই ব্যয় করাকেই যাকাত বলে।(ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ২১ খন্ড ৪৭৫ পৃঃ)।

প্রত্যেক ধনী মুসলিমের জন্য যাকাত দেওয়া অবশ্যই  কর্তব্য এবং ফরজ। সমাজের ধনী ও উচ্চবৃত্ত মানুষের অতিরিক্ত সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ নিয়মিত  দরিদ্র ও বঞ্চিত লোকদের মধ্যে যথাযথ বন্টন করাই বিধান রয়েছে পবিত্র কুরআনে। এই যাকাতের কথা পবিত্র কুরআনে  ৩২ বার উল্লেখ করা আছে।

যাকাতের উদ্দেশ্য

ধনি ব্যক্তিদের পবিত্র করার জন্য তাদের সম্পদ থেকে যাকাত দেওয়া উচিত কারণ যাকাত দেওয়ার মাধ্যমে তাদের বরকত হয় (সুরা তাওবাহ আয়াত ১০৩);

যাকাতের জন্য যে অংশ ব্যয় করা হয় তা যদি যাকাত দেওয়ার নিয়ম না মেনে দেওয়া হয় তাহলে 

আল্লাহর দরবারে পৌঁছায় না। মানুষ যদি শুধু দেখানোর জন্য দান করে, অথবা মানুষ যদি তাদের মহান দানকারী হিসেবে প্রশংসা করে,

অথবা কোনো পার্থিব প্রয়োজনে দান করে তাহলে সেই দান আল্লাহ তায়ালা গ্রহণ করবেন না। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য দান করলে আখেরাতে ভালো ফল পাওয়া যাবে এবং তার সম্পদ কখনো ইহজীবনে শেষ হবে না।

আল্লাহ ছাড়া আর কেউ ইসলামের বিধানের গোপনীয়তা ও প্রজ্ঞা সম্পূর্ণরূপে বোঝে না। তাই শরীয়তের যে কোনো আদেশের রহস্য বা প্রজ্ঞা যাই থাকুক না কেন,

বিনা দ্বিধায় সর্বশক্তিমান আল্লাহর আদেশ পালন করতে হবে। আল্লাহর আদেশ ঠিক মত পালন করলে যাকাত দেওয়ার নিয়ম ও আমি জানতে পারবেন।

জাকাত একটি নৈতিক ব্যবস্থাও কারণ এটি ধনীদের মধ্যে  লোভ এবং অহংকার আধ্যাত্মিক নোংরামি এবং নোংরামিকে পরিশুদ্ধ করে। এছাড়া তাদের মধ্যে উদারতা, দাতব্য ও দয়া এবং  ভালবাসাযর সৃষ্টি হয়। যাকাত দেওয়ার ফলে তারা অন্যের দুঃখের প্রতি সহানুভূতিশীলও হন।

যাকাত বঞ্চিতদের অন্তরে জ্বলে ওঠা ঈর্ষার আগুন নিভিয়ে দিতে একটি মহৎ কাজ করে, আর যাকাত ধনী ব্যক্তিদের সুখ ও সম্পদ দেখে তাদের হৃদয়ের বেদনা প্রশমিত করে।

যাকাত কোথায় ও কাকে দিতে হবে

আল্লাহ তায়ালা এ বিষয়ে বলেন: কেবলমাত্র ফকির, দরিদ্র, যাকাত প্রদানকারী, যাদের অন্তর ইসলামের প্রতি ঝুঁকতে পারে, ঋণগ্রস্ত এবং যারা আল্লাহর পথে চলেন তাদের যাকাত দেওয়া যায়। (সুরা তাওবাহ আয়াত ৬০); যে ৮ ধরনের ব্যক্তিদের যাকাত দেওয়ার নিয়ম আছে।

১) ফকির

এই শ্রেনীর মানুষ একেবারে নিঃস্ব তাদের কিছুই নেই তাই এদের যাকাত দেওয়া যায়।

২) মিসকীন

ফকিরদের চেয়ে মিসকীন কিছুটা উন্নত। উদাহরণস্বরূপ, তার 10 টাকা দরকার এবং তার কাছে মাত্র 7 টাকা। এই শ্রেণীর ব্যক্তিরা ও তাদের চাহিদা পূরন করতে পারে না। (সুরা কাহাফ আয়াত ৭৯)

৩) যাকাত সংগ্রহকারী

এরা সকলেই একটি দেশের ইমাম বা তার নায়েব কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি। এর মধ্যে রয়েছে গুদাম রক্ষক, হেফাজতকারী, লেখক, হিসাবরক্ষক, প্রহরী, এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবহনকারী এবং যারা পণ্য বিতরণ করে। তাদের যাকাতের জিনিসপত্র দেওয়া যেতে পারে।

যদি ধনীরা এই কাজটি স্বেচ্ছায় করে থাকে এবং উপরোক্ত ব্যক্তিদের জীবিকার অন্য উপায় থাকে, তবে তারা স্বেচ্ছায় (যদি তারা ইচ্ছা করে) মজুরি হিসাবে কিছু অর্থ পেতে পারে, তবে তাদের যাকাত দেওয়া বা নেওয়ার অনুমতি নেই।

আপনি যদি বনু হাশেমের অন্তর্ভুক্ত হন তবে আপনি যাকাত দিতে পারবেন না। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যাকাত ও দান মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধরদের অধিকার নয় (মুসলিম, মিশকাত হাদিস ১৭৩১/৩)

৪) যাদের অন্তর ইসলামের দিকে ঝুঁকেছে

যারা ইসলাম গ্রহণ করতে চায় বা তাদের শত্রুদের হাত থেকে মুসলমানদের রক্ষা করতে চায় তাদের যাকাত দেওয়ার নিয়ম আছে। 

যেমন সফওয়া ইবনু উমাইয়াকে হুনাইন যুদ্ধের গণীমাত দিয়েছিলেন। রাসুল (সাঃ) আবু সুফিয়ান ইবনু হারবকে দিয়েছিলেন। আক্‌বা ইবনু হাবেসকেও দিয়েছিলেন। উয়াইনাহ ইবনু মিহসান কেও দিয়েছিলেন (মুসলিম)

৫) ক্রিতদাস মুক্তিতে

ক্রীতদাসদের যারা মুক্তির নিবন্ধ লেখেন তাদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা যাবে। এছাড়া শত্রুর হাত থেকে বন্দী মানুষকে মুক্ত করার জন্য যদি অর্থের প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই অর্থ প্রদান করা যাবে। এই সমস্ত প্রচেষ্ট গুলো যাকাত তহবিল দ্বারা সাহায্য করা যেতে পারে।

৬) দেনাদার

যারা ঋণগ্রস্ত এবং দেনা শোধ করতে অক্ষম তাদের যাকাত দ্বারা সাহায্য করা যেতে পারে।

৭) যারা আল্লাহর রাস্তায় আছে

যারা দ্বীনের প্রচারে কাজ করে- যেমন: কেউ কুরআন হাদীস সংগ্রহ করে বই আকারে বিনামূল্যে বিতরণ করে। যারা মাদ্রাসা এবং এতিমখানা চালায় তাদের যাকাত দেওয়ার নিয়ম আছে।

৮) যাকাত দেওয়ার নিয়ম – রাস্তার পথিক

একজন ভ্রমণকারী যে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে বা এক দেশে যায় কিন্তু অর্থের অভাবে দেশে ফিরতে পারে না। সে নির্দিষ্ট পরিমাণ যাকাত পাবে যাতে সে দেশে ফিরে যেতে পারে। 

কতটা যাকাত দেওয়া প্রয়োজন

একজন মানুষের বেঁচে থাকতে হলে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের অবশ্যই দরকার হয়। এই সকল প্রয়োজন মেটানোর পর যদি অতিক্রম জমা অর্থ থাকে তাহলে তিনি যাকাত দিতে পারবেন।

তবে একেক জনের চাহিদা এবং খরচ করার ধরন এক রকমের নয়। কাউকে যাকাত দিতে হলে এমন ভাবে দিন যাতে তার প্রয়োজনে লাগে।

তবে সর্বোত্তম পন্থা হল গরীব রোগীর চিকিৎসার অর্থ পরিশোধ করা, অবিবাহিত ব্যক্তির বিবাহের জন্য অর্থ প্রদান করা এবং এমন ব্যবস্থা করা যাতে যাকাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে ভবিষ্যতে যাকাত পেতে না হয়।

যেমন কোনো কর্মের ব্যবস্থা করা। তাকে জীবিকা অর্জনের জন্য কিছু দিন। যেমন রিকশা, ট্রাক, গাড়ি, গরু, ছাগল, মুরগির খামার ইত্যাদি যাকাত হিসেবে দেওয়া হয় যাতে তার আর্থিক স্বচ্ছলতা মেটে।

সাহাবীরা একজন অসহায় ব্যক্তিকে এমন ভাবে যাকাত প্রদান করতেন পরবর্তীতে তার আর যাকাতের প্রয়োজন হতো না। 

খলিফা ওমর (রা.)-এর শাসনামলে যাকাত বা আর্থিক নিরাপত্তার আকৃতি এতই সুন্দর ছিল যে, সারাদিন ঘুরে বেড়ালেও যাকাত নেওয়ার মতো কাউকে পাওয়া যেত না।

খলিফা ওমর বিন আব্দুল আযীয (রাঃ)-এর আমলেও এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তিনি যাকাত নেওয়ার জন্য কাউকে না পেয়ে আফ্রিকা মহাদেশে গিয়ে যাকাত বন্টনের নির্দেশ দেন। ই

সলামের আবির্ভাবের পর, চার খলিফা এবং পরবর্তী কিছু খলিফার শাসনামলে যাকাত সংগ্রহ ও বিতরণ করা হয়েছিল এবং যদি বিশ্বব্যাপী মুসলিম সরকারগুলি দ্বারা অনুরূপ ব্যবস্থা আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করা হয়,

তবে সমস্ত মুসলমানদের জন্য পরিস্থিতি পরিবর্তিত হবে। কিন্তু রূঢ় সত্য হলো আজকের মুসলিম সমাজ কুরআনের এই নির্দেশকে উপেক্ষা করছে।

আমাদের নিকটতম দরিদ্র আত্মীয় বা সমাজের দরিদ্র ব্যক্তিদেরকে আমাদের যাকাত দেওয়া উত্তম যাতে তাদের আর্থিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তাদেরকে প্রতি বছর যাকাত আদায়ের জন্য দ্বারে দ্বারে যেতে হয়, তাতে তাদের অভাবের বণ্টনের কোনো পরিবর্তন হয় না।

যাকাত দেওয়া যাবে না যাদের

রাসুল (সাঃ) বলেছেন- যারা ধনী বা সামর্থ্যবান তারা যাকাতের ভাগ পাবে না। (আহমাদ, আবু দাউদ, নাসায়ী, মেশকাত হাদিস ১৭৩৮/১০)

আপনি যদি বনু হাশেম গোত্রের হন তবে আপনি যাকাত পাবেন না।

রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ যাকাত ও দান মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধরদের অধিকার নয় (মুসলিম, মিশকাত হাদিস ১৭৩১/৩)

উপসংহার 

উপরিউক্ত আলোচনা পরিশেষে আমরা জানতে পারলাম যাকাত কি এবং যাকাত দেওয়ার নিয়ম। একজন সম্পদশালী মুসলিম ব্যক্তিকে অবশ্যই যাকাত প্রদান করতে হবে।

সমাজে ধনী এবং দরিদ্ররা যাতে সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারে সেই জন্য যাকাত দেওয়া ধনীদের জন্য ফরজ। নিজের মানসিক প্রশান্তি এবং পরকালে চির সুখের জীবন যাপনের জন্য যাকাত দেওয়া জরুরি। 

যাকাত সম্পর্কিত প্রশ্ন ও উত্তর / FAQ

প্রশ্নঃ ১ লক্ষ টাকার যাকাত কত ?

উত্তরঃ যাকাতের পরিমাণ 1/40, বা 2.5%। এই ক্ষেত্রে, প্রতি 100,000 টাকার জন্য 2500 জাকাত প্রদেয়।

প্রশ্নঃ যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত গুলো কি কি?

উত্তরঃ জাকাত একমাত্র যাদের ওপর ফরজ

১. সম্পদের সম্পূর্ণ মালিকানা থাকা উচিত।

২. সম্পদ অবশ্যই উত্পাদনশীল এবং ক্রমবর্ধমান হতে হবে।

৩. নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী হতে হবে।

৪. সারা বছর মৌলিক চাহিদা পূরণের পর অতিরিক্ত সম্পদ থাকলেই যাকাত বাধ্যতামূলক।

৫. যাকাত আদায় করতে হলে ঋণমুক্ত হওয়ার পর নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ থাকতে হবে।

আরও পড়ুন-

যাকাত ফরজ হওয়ার শর্ত কয়টি ও যাকাতের সঠিক হিসাব

যাকাত হিসাব করার নিয়ম ও যাকাতের সঠিক পরিমান

Leave a Comment